বিশ্ব শান্তির রক্ষক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে যারা মরিয়া, শান্তি প্রতিষ্ঠায় শত শত কনভেনশন আর ট্রিটি স্বাক্ষর করে যারা নিজেদেরকে বিশ্বের কাছে শান্তির দূত হিসেবে প্রচার করছে, তারাই মানবাধিকারের নীতিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাচ্ছে। বিশ্ব শান্তি, নিরাপত্তা রক্ষা, এক দেশের প্রতি অন্য দেশের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বৃদ্ধি করা, মানবাধিকার ও জীবনমান উন্নয়নের লক্ষ্যে ১৯৪৫ সালে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ফ্রান্সের নেতৃত্বে জাতিসংঘ বা United Nations গঠন করা হয়েছিল। শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে নিরীহ নারী ও শিশুদের ওপর প্রাণঘাতী হামলা চলছে, যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের স্পষ্ট লঙ্ঘন। প্রেক্ষাপটে, জাতিসংঘের মহাসচিব যখন এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড বন্ধের আহ্বান জানান, তখন ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্র শান্তি প্রতিষ্ঠার নিছক অযুহাত দেয়।
১৯৪৮ সালে মানবাধিকারের সর্বজনীন ঘোষণাপত্র বা Universal Declaration of Human Rights – UDHR গৃহীত হয়। কিন্তু লজ্জার বিষয় হলো, এই ঘোষণাপত্রের প্রতিটি অনুচ্ছেদকে কলঙ্কিত করছে এই নৃশংস হামলাকারী গোষ্ঠী, যার নেপথ্যে রয়েছে স্বয়ং আমেরিকা। বরাবরই এই হত্যাকাণ্ড কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ কিংবা অন্যান্য মানবাধিকার সংগঠনের উল্লেখযোগ্য কোনো তৎপরতা দেখা যায়নি। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪৯ হাজার ফিলিস্তিনি শহীদ হয়েছেন। দখলদার ইসরাইলের পেছনে রক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে এই যুক্তরাষ্ট্র। কিছুদিন আগে বাইডেনের দ্বৈত নীতি দেখেছে বিশ্ব, এখন দেখছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের দ্ব্যর্থক ভূমিকা। একদিকে যুদ্ধ বন্ধের গান গায়, অন্যদিকে অস্ত্র ও আর্থিক সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ কেবল যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ হলো ফিলিস্তিনবাসীকে নিশ্চিহ্ন করে ইহুদি সাম্রাজ্য তৈরি করার।
যদিও বলা হচ্ছে যে এই সহিংসতা সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে চালানো হচ্ছে, আসলে চিত্রটি কতটা অদ্ভুত! শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে এই সন্ত্রাসী জাতি সমগ্র বিশ্বে অশান্তি আর হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। যেখানে যুদ্ধ চলাকালীন সময় বেসামরিক বা সাধারণ মানুষ হত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ, সেখানে সাধারণ ফিলিস্তিনির রক্তে হোলি খেলছে এই সন্ত্রাসী ইহুদি গোষ্ঠী। জেনেভা কনভেনশন – ১৯৪৯-এ স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে বেসামরিক মানুষের নিরাপত্তা এবং সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। রোম সংবিধি – ১৯৯৮ অনুসারে যুদ্ধাপরাধ, গণহত্যা এবং মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। হেগ কনভেনশন – ১৮৯৯ ও ১৯০৭ এর অনুচ্ছেদ ২৩-এ যুদ্ধকালীন সময় অতি নিষ্ঠুরতা, অপ্রয়োজনীয় ধ্বংসযজ্ঞ, এবং খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করা সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ। অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ২৫-এ বলা হয়েছে যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আবাসিক এলাকা, হাসপাতাল ও ধর্মীয় স্থাপনায় হামলা করা যাবে না। এসব ঘটনা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যায়িত হয়, কিন্তু বাস্তবতা কতটা নির্মম তা আমাদের সকলেরই জানা। অন্যদিকে অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো বিবৃতি দিয়ে নিজেদের দায় এড়ানোর চেষ্টা করছে। এর চেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, আরব দেশগুলোর প্রতিবাদের কণ্ঠও কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তারা চাইলে হুংকার দিয়ে ফিলিস্তিনের পাশে থাকতে পারে, আমেরিকা ও ইসরাইলের পণ্য তাদের দেশে বিক্রয় বন্ধ করে দিতে পারে, যৌথ সামরিক মহড়া পরিচালনা করতে পারে।
এই যুদ্ধের বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় প্রতীয়মান হয় যে নতুন করে ফিলিস্তিন দখলের পাঁয়তারা চলছে। এর থেকে বড় বিষয় হলো, ফিলিস্তিন নামক কোনো দেশ পৃথিবীর মানচিত্রে থাকুক – এটা ইসরায়েল চায় না। এই উদ্দেশ্য হাসিলের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে দখলদার ইসরায়েল এবং তার মিত্ররা।
এই যুদ্ধ বন্ধের জন্য আলোচনার টেবিল এখন মোটেও প্রস্তুত নয় এবং এমন কিছু আশা করাও কাম্য নয়। কারণ, এই মুহূর্তে যুদ্ধ বন্ধ করতে পারে কেবল যুক্তরাষ্ট্র, কিন্তু সেখানে তারা আগুনে ঘি ঢালার কাজ করছে। অন্যথায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত যে নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্ট-কে অপরাধী ঘোষণা করে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে, তাদের পক্ষ নেবে কেন? সুতরাং এখন যুদ্ধ বন্ধে যা করা যেতে পারে তা হলো, দেশে দেশে গণ আন্দোলন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যুদ্ধবিরোধী প্রচারণা, মানবিক সহায়তা সরবরাহ সচল রাখা এবং সাধারণ জনগণের নিরাপত্তা বজায় রাখতে প্রচারণা, পণ্য বয়কট করা, আন্তর্জাতিক চাপ প্রয়োগ, আরব জোটের বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখা এবং প্রয়োজনে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা এবং অন্যান্য পরাশক্তিধর দেশগুলোকে এ বিষয়ে ইতিবাচক করে তোলা।
মোঃ আরিফ উল্লাহ
গবেষক ও উন্নয়নকর্মী
arifcbiu@gmail.com
0 Comments