ভাইরালঃ তরুণ প্রজন্মের মাঝে অসুস্থ প্রতিযোগিতা ও সামাজিক বাস্তবতা



জান্নাতুল তাবাসসুম
আধুনিক যুগে প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে তরুণ প্রজন্মের জীবনযাত্রা ও চিন্তাভাবনায় আমূল পরিবর্তন এসেছে। এই পরিবর্তনের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো তরুণদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসুস্থ প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র শিক্ষা বা পেশাগত ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি সামাজিক মর্যাদা, শারীরিক সৌন্দর্য, জীবনযাপনের মান এবং এমনকি ব্যক্তিগত সম্পর্কের ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়েছে। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক-এর মতো সামাজিক মাধ্যমগুলো তরুণদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার অন্যতম প্রধান কারণ। এই প্ল্যাটফর্মগুলোতে ব্যবহারকারীরা তাদের জীবনের সেরা মুহূর্তগুলো শেয়ার করে, যা অন্যদের মধ্যে হীনমন্যতা ও প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। অনেক তরুণই এই "হাইলাইট রিল" দেখে নিজেদের জীবনকে তুলনা করতে শুরু করে, যা তাদের মানসিক চাপ ও হতাশার কারণ হয়ে দাঁড়ায়।অনেক পরিবারেই সন্তানদেরকে অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকতে বাধ্য করা হয়। উচ্চ শিক্ষা, ভালো চাকরি, সামাজিক মর্যাদা ইত্যাদি ক্ষেত্রে সন্তানদেরকে প্রতিযোগিতায় নামতে হয়। এই চাপ তরুণদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। বর্তমান সমাজে সৌন্দর্য, সাফল্য এবং সম্পদকে অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়। মিডিয়া এবং বিজ্ঞাপনগুলো তরুণদেরকে একটি নির্দিষ্ট জীবনযাত্রার আদর্শ হিসেবে উপস্থাপন করে, যা তাদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার জন্ম দেয়। অসুস্থ প্রতিযোগিতা তরুণদের মধ্যে উদ্বেগ, হতাশা এবং মানসিক চাপের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। অনেক তরুণই এই চাপের কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে এবং তাদের আত্মবিশ্বাস হারিয়ে ফেলে। প্রতিযোগিতার এই সংস্কৃতি তরুণদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। বন্ধুত্ব, প্রেম এবং পারিবারিক সম্পর্কে প্রতিযোগিতার ছায়া পড়ে, যা সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে।
অসুস্থ প্রতিযোগিতার ফলে অনেক তরুণই নৈতিকতা ও মূল্যবোধকে ত্যাগ করে সাফল্য অর্জনের পথে এগিয়ে যায়। এই প্রবণতা সমাজে অনৈতিক কাজকর্ম ও দুর্নীতিকে বাড়িয়ে তোলে।


বর্তমান সমাজে অসুস্থ প্রতিযোগিতা একটি বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রতিযোগিতা শুধুমাত্র ব্যক্তিগত পর্যায়েই সীমাবদ্ধ নেই, বরং এটি সামাজিক কাঠামোকে প্রভাবিত করছে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে এই প্রতিযোগিতা তাদেরকে একাকী ও বিচ্ছিন্ন করে তুলছে। অনেক তরুণই এই প্রতিযোগিতার চাপে নিজেদের স্বপ্ন ও আগ্রহকে ত্যাগ করে সমাজের নির্ধারিত স্ট্যান্ডার্ড অনুসরণ করতে বাধ্য হচ্ছে।
তরুণদের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতার নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক সংগঠনগুলো এই বিষয়ে কর্মশালা ও সেমিনারের আয়োজন করতে পারে। তরুণদেরকে সামাজিক মাধ্যমের সঠিক ব্যবহার সম্পর্কে শিক্ষা দিতে হবে। তাদেরকে বুঝতে হবে যে, সামাজিক মাধ্যমের পোস্টগুলো বাস্তব জীবনের সম্পূর্ণ চিত্র নয়। পরিবারকে তরুণদের উপর চাপ কমাতে হবে এবং তাদেরকে তাদের নিজস্ব গতিতে বেড়ে উঠতে দিতে হবে। সন্তানদের সাফল্যকে শুধুমাত্র নম্বর বা চাকরির মাধ্যমে মূল্যায়ন না করে তাদের ব্যক্তিগত বিকাশ ও সুখকে গুরুত্ব দিতে হবে।

তরুণ প্রজন্মের মধ্যে অসুস্থ প্রতিযোগিতা একটি জটিল সামাজিক সমস্যা, যা তাদের মানসিক স্বাস্থ্য, ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং সামাজিক কাঠামোকে প্রভাবিত করছে। এই সমস্যার সমাধানে সমাজের সকল স্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। তরুণদেরকে তাদের নিজস্ব গতিতে বেড়ে উঠতে দেওয়া এবং তাদের মধ্যে ইতিবাচক প্রতিযোগিতার মনোভাব গড়ে তোলাই এই সমস্যা থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায়।


লেখক:
জান্নাতুল তাবাসসুম
শিক্ষার্থী, কক্সবাজার সরকারি কলেজ। 
ইমেইল: tasnursafa5823@gmail.com

Post a Comment

0 Comments