একজন মানবিক ম্যাজিস্ট্রেটের গল্প

জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের শাহিন শিরাজ স্যারের ফেসবুক থেকে নেয়া।

একদিন সস্ত্রীক গাড়ি ড্রাইভ করে চট্টগ্রাম শহরের জিইসি মোড় পার হয়ে গোল পাহাড় মোড়ের দিকে যাচ্ছিলাম। মেট্রোপলিটন হাসপাতাল পার হওয়ার সময় দেখি যে একজন সিএনজি ড্রাইভারকে এক যুবক প্রচন্ড মারধর করছে সাথে আরো কয়েকজন মিলে যে যেভাবে পারছে পেটাচ্ছে। অসংখ্য পথচারী জটলা করছে। যে যুবক পেটাচ্ছে তাকে বলতে শুনলাম,,,শালা তোরে আজ আমার হাত থেকে কেউ বাঁচাতে পারবেনা। অসংখ্য লোক মিলে একজনকে পেটাচ্ছে অথচ কেউ উদ্ধার করতে এগিয়ে


আসছেনা। এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আমি কিইবা করতে পারি? আশেপাশে তো নিশ্চয় পুলিশ আছে এই ভেবে গাড়ি ড্রাইভ করে পঞ্চাশ গজ সামনে চলে গেলাম। নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগলো এই ভেবে যে একজন জীবন্ত মানুষকে পিটিয়ে মেরে ফেলছে অথচ কেউ উদ্ধার করতে এগিয়ে এলোনা! আমার স্ত্রী বললো তুমি কিছু করার চেষ্ঠা কর,,লোকটাকে তো মেরেই ফেলবে! চিন্তা করলাম শতশত মানুষের ভীড়ে আমাকে কে চিনবে, আর আমার কথাই বা তারা শুনবে কেন? আবার এরকম ভয়ংকর পরিস্থিতিতে গিয়ে আবার না নিজেকে মাইর খেতে হয়? আবার জিইসি মোড়ে এমন ভয়াবহ যানজট,কার পার্কিং করার সামান্যতম সুযোগও নেই। সাতপাঁচ ভেবে সময় নষ্ট না করে হুট করে প্রাইভেট কারটি রাস্তার একপাশে রেখে বউকে বললাম তুমি বসে থাকো, গাড়িতে নেমপ্লেট আছে যতই সমস্যা হোক কেউ তোমাকে কিছু বলার সাহস করবেনা। সে বললো তুমি যাও আল্লাহ ভরসা। 


গাড়ি থেকে নেমে দিলাম দৌড়,,,,গিয়ে দেখি যে, যে যেভাবে পারে  সিএনজি ড্রাইভারকে পেটাচ্ছে, তার নাকমুখ থেঁতলে রক্ত ঝরছে,,,,সে জাস্ট মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার আকুতি করছে আর ঐদিকে তাকে টেনে হেঁচড়ে কুকুর যেভাবে হরিণকে আক্রমণ করে সেভাবে কিল-ঘুষি মারছে। দেরী না করে প্রচন্ড ভীড়ের ভিতরে ঢুকে পড়লাম, জাস্ট সিএনজি ড্রাইভের সামনে বুক চিতিয়ে ঢাল হয়ে দাড়াঁলাম। পরিচয় না দিলে পাত্তাই পাবোনা জেনে জোরে চিল্লিয়ে নিজের পরিচয় দিলাম। লোকজন চিন্তাই করতে পারেনি একজন ম্যাজিস্ট্রেট ভয়ংকর মারামারি মধ্যে ঢুকে একজনকে বাঁচাতে আসবে। প্রথমে তারা আমাকে পাত্তাই দিচ্ছিলনা,,,,এবং ঐ যুবকটি সিএনজি ড্রাইভারকে আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে আর বলছে, কু,,,,বাচ্চা তোকে আজকে মরতেই হবে,,,,,,,,দীর্ঘক্ষণ লড়াই করার পর সিএনজি ড্রাইভারকে তার গাড়ির মধ্যে তুলে দিলাম,,,,,,তবুও জনতা চেষ্টা করছে সিএনজির দরজা ভেঙে তাকে কিল-ঘুষি মারার,,,,,,সে বললো স্যার,,,জানে বাঁচান,, আমার বউ বাচ্চা আছে,,,,,,(,কি ভয়াবহ পরিস্থিতি লিখে বুঝানো সম্ভব না).,,,, লোকজনকে বললাম যদি আপনারা আইন হাতে তুলে নেন তাহলে কেউ বাঁচতে পারবেন না,,,,,,আমি নিজেই আপনাদের বিরুদ্ধে মামলা করবো,,,,,,,,,,,,প্রায় আধাঘন্টা ধরে ব্যাপক বাকবিতন্ডার মধ্যে কোন রকমে সিএনজি ড্রাইভারকে তার সিএনজিতে তুলে দিয়ে বললাম আপনি দ্রুত পালান,,,,,,,,,,তার রক্তাক্ত শরীরে গাড়ি চালানোর শক্তি ছিলো বলে মনে হয়নি তবুও সে গাড়ি টান দিলো,,,,,, জীবন বাঁচানোর জন্য,,,,,,,, ঐদিকে ঐ যুবক বললো আপনি ম্যাজিস্ট্রেট বলে শালা আজকে বেঁচে গেলো,,,,না হলে,,,,,,,,,,,,সে বললো আপনি ম্যাজিস্ট্রেট,,,,,,,,,,আমিও অমুক কলেজের অমুক,,,,,,,,,,,তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করলাম,,,,,নিজের ভিজিটিং দিলাম,,,,,,,,,,,তার অভিযোগ হল সে যখন মোটরসাইকেল চালাচ্ছিল তখন সিএনজি ড্রাইভার তার মোটরসাইকেলের পিছনে ধাক্কা দেয় কিন্তু তাকে সিগনাল দিলেও সে সিএনজি না থামিয়ে গতি বাড়িয়ে পালাতে থাকে। বহুদূর ধাওয়া দিয়ে সে সিএনজি ড্রাইভারকে জিইসি মোড়ে এসে ধরতে পেরেছে। 


বুঝলাম সে প্রতিশোধের নেশায় এই ঘটনা ঘটিয়েছে আর উৎসুক জনতা পেটানোর সুযোগ পেয়ে একজন মানুষকে মেরে ফেলতেই লাগছিলো। আহ্ জীবন, কি ভয়ংকর, কি অমানবিক,, কি অপরিনামদর্শী,,,,,,,,,,,জিইসি মোড়,,,চট্রগাম,,,,,,,,সবাই কেবল ছুটে চলছে,,,,কারও দিকে তাকানোর কারও সময় নেই,,,,,,প্রায় আধাঘন্টা পরে দৌঁড়াতে দৌড়াতে এসে গাড়ি স্ট্যার্ট দিলাম,,,,,,বউকে ঘটনা বললাম,সে বললো সবি উপরওয়ালা ইশারা,,,,,,,ধন্যবাদ তোমাকে,,,,,,, একটি জীবন বাঁচাতে পেরে কিংবা একজন বিপদগ্রস্ত মানুষকে সমূহ বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারার অপার্থিব আনন্দে মনটা ভরে উঠলো,,,,,,,,,,,,,, ,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,,, আজকে দুপুরে ফেনী শহরের মহিপাল মোড় দিয়ে পায়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম,,,,দেখলাম এই লোকটি রক্তাক্ত,,,, রক্তে তার জামাকাপড় ভিজে যাচ্ছে,,,,,,,,,,,বিশাল জটলা,,,,,,,ভাবলাম চট্টগ্রাম আমার শহর না হলেও ফেনী তো আমার শহর,,,,,কোন দেরী না করেই ভীড়ের মধ্যে ঢুকে গেলাম। যা বুঝলাম ভাড়া নিয়ে তর্কাতর্কির এক পর্যায়ে যাত্রী সাহেব ( কলেজ পড়ুয়া এক ছেলে) রিকশার ড্রাইভারকে ঘুষি মেরে কপাল পাটিয়ে দিয়েছে,,,, লোকজন দুভাগে বিভক্ত,,,,,,,, ছেলেটাকে ধরে ফেললাম শক্ত করে,,,,,,লোকজন বললো স্যার,,,,,,আপনি যা করেন,,,,,,,,,পুলিশকে কল দিবো,,,,,তখন ,,,,,,,,,,সবাই বললো স্যার,,,,,পুলিশকে কল না করে আপনি একটা সিদ্ধান্ত দেন,,,,,,,,রিকশা ড্রাইভারকে পাশের ফার্মেসিতে নিয়ে গেলাম,,,,,,,,প্রাথমিক চিকিৎসা সহ প্রয়োজনীয় ঔষধ নিয়ে দিলাম,,,,,,,,সাথে উপস্থিত জনতা এবং আহত রিকশা ড্রাইভারের ইচ্ছা অনুযায়ী ঐ ছেলেকে বললাম ক্ষমা চাইতে এবং  ক্ষতিপুরণ দিতে,,,,,,,,,,সবশেষে ক্ষমা ও ক্ষতিপূরণের মাধ্যমে ঘটনা মিটমাট করে রওয়ানা দিলাম,,,,,,,আর আমি হাঁটা দিলাম জগতের বিচিত্র পথে,,,,,,,,,,

Post a Comment

0 Comments